
বিদায় বলাটা সবসময় কঠিন, কিন্তু ক্রিকেটারের জন্য সেটা আরও কঠিন। মাঠ, ড্রেসিংরুম, স্টেডিয়ামের গর্জন—এসবই তো ছিল তার নিত্যসঙ্গী। দিনের পর দিন, বছরের পর বছর এই ব্যাট-বলকেই জীবনসঙ্গী বানিয়ে নেওয়া। সেই সম্পর্কের ইতি টানা কি এতই সহজ? আজ যখন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বলছেন, “এটাই শেষ,” তখন কি তার বুকটা হাহাকার করে ওঠেনি? হাতের তালুর মতো চেনা প্যাড, গ্লাভস, ব্যাট—সব কিছু কি এক মুহূর্তের জন্য মনে করিয়ে দেয়নি তার জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো? হয়তো চোখের কোণে জলও জমেছিল, হয়তো গলা বুজে এসেছিল, কিন্তু তিনি সেসব প্রকাশ করেননি।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ‘সাইলেন্ট কিলার’ খ্যাত মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ—যিনি চুপচাপ থেকে, নিঃশব্দে প্রতিপক্ষের হৃদয়ে ভয় ধরাতেন। কখনও স্পটলাইটের জন্য লড়েননি, কখনও নিজের কীর্তির জন্য উচ্চকণ্ঠ হননি। তিনি জানতেন, তার কাজ পারফর্ম করা, দলের প্রয়োজনে নির্ভরতার প্রতীক হয়ে ওঠা।
প্রায় ১৮ বছরের ক্যারিয়ার। উত্থান-পতনের এক দীর্ঘপথ। বিশ্বকাপের মঞ্চে ব্যাক-টু-ব্যাক সেঞ্চুরি, আবার সেই তিনি একসময় দলের বাইরেও থেকে গেছেন দীর্ঘদিন। কখনো প্রশংসার বন্যায় ভেসেছেন, কখনো সমালোচনার ঝড়েও টিকে থেকেছেন। দর্শকরা তাকে মাথায় তুলেছেন, আবার ঠেলে নামাতেও দ্বিধা করেননি। এটাই তো ক্রিকেট, এটাই তো পারফর্মিং আর্ট!
রিয়াদ জানতেন, এই সমালোচনাগুলো অবধারিত। হয়তো তিনি গায়ে মাখেননি, হয়তো মেখেছেন, কে জানে? তবে, তিনি কখনোই ভেঙে পড়েননি। লড়াই করে গেছেন, ফিরে এসেছেন। যখন সবাই ধরেই নিয়েছিল, তিনি শেষ, তখনও তিনি লড়াই করেছেন, প্রমাণ করেছেন—তিনি এখনো আছেন, তিনি এখনো দিতে পারেন।
একসময় কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খেলেছেন মাশরাফী, সাকিব, মুশফিক, তামিমের সঙ্গে। কিন্তু সময়ের ফেরে একে একে সবাই সরে গেছেন। মাশরাফী বিদায় নিলেন, সাকিব নিষেধাজ্ঞা ও বিতর্কের ধাক্কায় কিছুটা দূরে, তামিমও গুডবাই বলে দিলেন। মুশফিক শুধু টেস্ট ফরম্যাটে টিকে আছেন, সেটাও হয়তো সাময়িক।
তাহলে রিয়াদ কি ভাবলেন—”একা একা থাকার কোনো মানে নেই?”
বাংলাদেশ ক্রিকেটে একসময়কার ‘ফ্যাব ফাইভ’ এর সদস্যদের মধ্যে তিনজন নেই। একজন আছেন শুধু টেস্টে, আর তিন ফরম্যাটেই ছিলেন শুধু তিনি, রিয়াদ। একাকী এক শেরপা, পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে থাকার মতো এক নিঃসঙ্গতা! এই বোঝাটা হয়তো আর নিতে চাননি তিনি।
প্রত্যেক ক্রিকেটারের স্বপ্ন থাকে মাঠ থেকেই বিদায় নেওয়ার। দর্শকদের অভিবাদন, সতীর্থদের কাঁধে তোলা, শেষবারের মতো ব্যাট উঁচিয়ে বিদায় জানানো—এটাই তো প্রাপ্য ছিল তার। কিন্তু তিনি পেলেন না। হয়তো চেয়েছিলেন, কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবার সে সৌভাগ্য হয় না।
এখানেই কি একটা তীব্র বেদনা লুকিয়ে থাকল? ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে তাকে বসিয়ে রাখা হলো, দলে সুযোগ পেলেন না, অথচ বিদায়ের ঘোষণা আসেনি। অপেক্ষা করলেন, কিন্তু কেউ ডেকে বলল না—”আয় রিয়াদ, শেষটা মাঠে শেষ করো!”
চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সে ক্রিকেট চালিয়ে নেওয়া কঠিন। বাস্তবতা মেনে নিয়েই হয়তো তিনি সরে দাঁড়ালেন। কিন্তু যা রেখে গেলেন, তা বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে অমলিন থাকবে। কখনো তার নাম উচ্চারিত হবে সাহসের প্রতীক হিসেবে, কখনো নির্ভরতার প্রতিচ্ছবি হয়ে, কখনোবা সেই নিঃশব্দ যোদ্ধা হিসেবে, যিনি নিজের কাজটা নিভৃতে করে গেছেন।
হয়তো অনেক বছর পর, কোনো তরুণ ক্রিকেটার যখন লড়াই করবে, ব্যর্থতার বোঝা মাথায় নিয়ে চুপচাপ বসে থাকবে, তখন কোচ হয়তো বলবেন—”মনে আছে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে? দেখো, তিনিও হার মানেননি!”
এভাবেই হয়তো যুগ যুগ ধরে, ইতিহাসের পাতায়, গল্পের আড্ডায়, স্মৃতির মঞ্চে বেঁচে থাকবেন ‘সাইলেন্ট কিলার’।
বিদায় রিয়াদ, হয়তো চিরতরে নয়, হয়তো নতুন কোনো ভূমিকায় আবার দেখা হবে!